মহাবিশ্বের দরবারে এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের দরজা খুলে গেলো। বড়দিনে, মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার (NASA) তরফে, এযাবৎ বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী স্পেস টেলিস্কোপটি উৎক্ষেপণ করা হল, যা উন্মোচন করবে গোটা বিশ্ব ব্রম্ভান্ডের অজানা রহস্যের মোড়ক।
নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (James Webb Space Telescope), আগামী প্রজন্মের স্পেস অবজারভেটরি বা মহাকাশ পর্যবেক্ষক হিসেবে দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূলে ফ্রেঞ্চ গুয়ানার Kourou স্পেসপোর্ট থেকে ইউরোপীয় আরিয়ান ৫ (Ariane 5) রকেটে চড়ে পাড়ি জমালো মহাশূন্যে।
এই ব্যতিক্রমি যন্ত্রটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার, যা ভারতীয় মুদ্রার হিসেবে ৭৫,৩৩০ কোটি টাকার সমান। মূলত, জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মহাকাশ সম্বন্ধীয় অপার কৌতূহল নিবারণের উদ্দেশ্যই বিশেষ ভাবে বানানো এই টেলিস্কোপটি প্রেরিত হয়েছে। ১৩৮০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং বা মহা-বিস্ফোরণের পর ব্রহ্মাণ্ড কী ভাবে তৈরি হয়েছিল, কী ভাবেই বা তৈরি হয়েছিল প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের তারাগুলি, কী ভাবে এলো ছায়াপথ বা ক্লাস্টার, সেগুলি জানতে ও বুঝতে সাহায্য করবে এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ।
তিন দশক আগে, প্রায় একই উদ্দেশ্যে নাসা থেকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল হাবল নামে আর এক স্পেস টেলিস্কোপকে। তবে ব্রহ্মাণ্ডের ১২০০ কোটি বছরের বেশি ইতিহাসকে খুঁড়ে দেখার ক্ষমতা নেই হাব্ল এর। আর তাই, বিজ্ঞানীদের অস্ত্র এবার জেমস্ ওয়েব।
নাসা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শনিবার সন্ধ্যায়, রকেটটি উৎক্ষেপণের আধ ঘণ্টার মধ্যেই টেলিস্কোপের পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগকারী বিশাল অ্যান্টেনাটি খুলে যাবে আর শক্তি জোগানোর জন্য প্রয়োজনীয় সোলার প্যানেলগুলিও খুলে যাবে। উৎক্ষেপণের ৬ দিন পর, টেলিস্কোপের সানশিল্ডগুলিও ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করবে। যা তীব্র সূর্যরশ্মি আর তাপের প্রকোপ থেকে এটিকে বাঁচাবে। উৎক্ষেপণের দ্বিতীয় সপ্তাহে টেলিস্কোপের মধ্যে থাকা আয়নাটিও খুলে যাবে। এবং তারও ৬ মাস পর থেকে শুরু হবে ব্রহ্মাণ্ড মন্থনের পালা।
পূর্বসূরী টেলিস্কোপ, হাবল এর চেয়ে অপেক্ষাকৃত অনেক দূর পর্যন্ত নজরদারি চালাতে সক্ষম হবে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের সৃষ্ট এই নয়া বিস্ময়। তার পর্যবেক্ষণ চলবে অনেক দূরে পৌঁছায় এমন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অবলোহিত রশ্মি (‘ইনফ্রারেড রে’) তরঙ্গে। উল্লেখ্য, জেমস ওয়েবকে বসানো হবে পৃথিবী থেকে ১০ লক্ষ মাইল দূরবর্তী কোনো স্থানে। প্রায় একটি স্কুল বাসের সমান ওজনের এই টেলিস্কোপটি সেখান থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে। আবার, সূর্য থেকে দেখলে, টেলিস্কোপটির অবস্থান দেখাবে পৃথিবীর পিছনে। এ ব্যাপারেও হাবল কে টেক্কা দিয়েছে জেমস ওয়েব, কারণ হাবল কেবল পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতেই সক্ষম।
এই টেলিস্কোপের প্রধান আকর্ষণ হল, সাড়ে ২১ ফুট বা সাড়ে ৬ মিটার চওড়া সুবিশাল আয়না যার ভিতরে ১৮টি ছোট ছোট আয়না বর্তমান। অবলোহিত রশ্মি প্রতিফলনের উদ্দেশ্য আবার, বেরিলিয়াম দিয়ে বানানো সেই আয়নাগুলির উপরি ভাগ সোনার পাতে মুড়ে দেওয়া রয়েছে।
সর্বোপরি, মহাকাশ গবেষণায় এক নতুন সূচনার সূত্রপাত করলো এই টেলিস্কোপ সমন্বিত রকেটের সফল উৎক্ষেপণ। এবার, মহাকাশেও তাই আক্ষরিক অর্থেই পালিত হল বড়দিন। আর এই ক্রিসমাস ডে হয়ে থাকলো একটা গোটা সভ্যতার কাছে মহাকাশ অভিযানের ‘রেড লেটার্স ডে’।