ভারতের স্মার্টফোন বাজারে ৩টি বড় বদল আনতে চলেছে সরকার, কী আছে বৈদেশিক ব্র্যান্ডগুলির কপালে?

বিগত কয়েক বছর ধরে ভারতের স্মার্টফোন মার্কেটে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে চীনা কোম্পানিগুলি। অন্তত এন্ট্রি-লেভেল এবং মিড-রেঞ্জ বাজেট সেগমেন্টে মূলত চীনা কোম্পানিগুলির রমরমাই দেখা যায়। অপরদিকে, প্রিমিয়াম সেগমেন্টের রথের রশিটি নিজেদের হাতে রেখেছে Apple (অ্যাপল) এবং Samsung (স্যামসাং)। অর্থাৎ সোজা কথায় বললে, ভারতের স্মার্টফোন মার্কেটে দেশীয় কোম্পানির চাইতে বিদেশি কোম্পানিগুলির আধিপত্যই বেশি। তবে এবার এই ছবিটাকে পাল্টে দিতে স্মার্টফোন ও মোবাইল সেগমেন্টের সাথে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে সরকার, যার ফলে ভারতীয় স্মার্টফোন মার্কেটের ভোল পাল্টে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ, মূলত যে বিষয়গুলিকে ভারত সরকার নিজেদের বিবেচনার তালিকায় রেখেছে তার মধ্যে রয়েছে রাইট টু রিপেয়ার, দুই ধরনের চার্জিং পোর্টের অস্তিত্ব এবং ১২,০০০ টাকার কম বাজেট সেগমেন্টে চীনা কোম্পানিগুলিকে নিষিদ্ধ করা।

সেক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক প্রণোদিত নতুন নিয়মগুলি যে কেবলমাত্র চীনা সংস্থাগুলিকে ভাতে মারবে তা নয়, আমেরিকান ব্র্যান্ডগুলির ওপরও এর বিশেষ প্রভাব পড়বে। তবে উক্ত তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত ভারতের স্মার্টফোন মার্কেটে কীরূপ প্রভাব ফেলবে, আসুন তা জেনে নেওয়া যাক।

সস্তার চাইনিজ স্মার্টফোন কি বন্ধ হয়ে যাবে?

প্রথমেই ১২,০০০ টাকার কম সেগমেন্টে চীনা সংস্থাগুলির ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞার কথায় আসা যাক। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ভারতে বাজেট রেঞ্জের স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, এমন মানুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। কাউন্টারপয়েন্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১২,০০০ টাকার কম বাজেটের সেগমেন্টটি ভারতে সবচেয়ে জনপ্রিয়। আর এর মধ্যে শাওমি (Xiaomi), রিয়েলমি (Realme), ওপ্পো (OPPO), ভিভো (Vivo), পোকো (POCO), রেডমি (Redmi), আইটেল (itel), ইনফিনিক্স (Infinix) এবং টেকনো (Tecno)-র মতো সংস্থাগুলি এই রেঞ্জের স্মার্টফোন তৈরি করে। তবে দিন দুয়েক আগের একটি রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে যে, সরকার ১২,০০০ টাকার কম বাজেটের স্মার্টফোন সেগমেন্ট থেকে চীনা কোম্পানিগুলিকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে এর ফলে কার্বন (Karbonn), লাভা (Lava), মাইক্রোম্যাক্স (Micromax)-এর মতো সংস্থাগুলি বিশেষ উপকৃত হবে। কারণ দেশীয় কোম্পানিগুলিকে চাঙ্গা করতেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে চীনা কোম্পানিগুলির পাশাপাশি স্যামসাং এবং নোকিয়া (Nokia)-ও এই রেঞ্জের স্মার্টফোন বিক্রি করে। আর একথা অনস্বীকার্য যে, এই মুহূর্তে স্যামসাং এবং নোকিয়া অন্য যেকোনো ভারতীয় স্মার্টফোন ব্র্যান্ডের চেয়ে অধিক শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। বহু ইউজারই এই সংস্থাদ্বয়ের স্মার্টফোনগুলিকে বিশেষ পছন্দ করেন। তাই চীনা কোম্পানিগুলির এই কোণঠাসা পরিস্থিতিতে উক্ত সংস্থা দুটিও ব্যাপকভাবে লাভবান হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

চার্জিং পোর্টেও আসতে চলেছে বদল

আগামী সপ্তাহে চার্জিং পোর্ট নিয়েও বৈঠক করার কথা রয়েছে সরকারের। এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য হল, একই সেগমেন্টের ডিভাইসগুলিতে আলাদা আলাদা চার্জিং পোর্টের অস্তিত্ব নির্মূল করা। আসলে ব্যাপারটা হল ফিচার ফোন, অ্যান্ড্রয়েড ফোন, ইয়ারবাডস কিংবা ল্যাপটপ – প্রতিটি ডিভাইসেই আলাদা আলাদা চার্জিং পোর্টের দেখা মেলে। আবার, অ্যাপল (Apple) তাদের আইফোন (iPhone)-এ লাইটনিং পোর্ট ব্যবহার করে। এর ফলে ইউজারদেরকে বিভিন্ন ডিভাইসের জন্য বিভিন্ন চার্জার ব্যবহার করতে হয়। এই সমস্যার সমাধান করতেই সরকার মাত্র দুটি চার্জিং পোর্ট নিয়ে একটি নতুন নীতি আনতে চলেছে। এই নীতিটি কার্যকর হলে ফিচার ফোনের জন্য একটি চার্জিং পোর্ট এবং অন্য ধরনের ডিভাইসগুলিতে অপর একটি চার্জিং পোর্টের দেখা মিলবে। এর ফলে ইউজাররা যে ব্যাপকভাবে উপকৃত হবেন, সেকথা বলাই বাহুল্য।

তবে উক্ত নীতিটির আগমন ঘটলে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে টেক জায়েন্ট অ্যাপল। এমনিতেই অ্যাপল তার ফোনগুলির সাথে বক্সে চার্জার দেয় না। আবার আইফোনের ক্ষেত্রে ইউজারদেরকে লাইটনিং কেবল ব্যবহার করতে হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, কোম্পানির আয়ের একটি বড়ো অংশ চার্জার বিক্রি থেকেই আসে। এমত পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের এই নয়া নীতিটি কার্যকর হলে মার্কিন সংস্থাটি বেশ বড়োসড়ো ধাক্কা খাবে।

রাইট টু রিপেয়ার

রাইট টু রিপেয়ার বা যেকোনো ডিভাইস মেরামতির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো ডিভাইস রিপেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলি নিজেদের ইচ্ছামতো নিয়ম প্রয়োগ করে থাকে। যেমন ধরা যাক, আপনার ল্যাপটপে কেবল একটি বাটনে সমস্যা দেখা দিয়েছে, কিন্তু সার্ভিস সেন্টারে নিয়ে গেলে তারা পুরো প্যানেলটিই চেঞ্জ করে দেয়। আবার স্মার্টফোনের কথা বললে, অনেক সময় ইউজারদের ফোনের স্ক্রিনে ক্র্যাক দেখা যায়। এমত পরিস্থিতিতে সাধারণ কোনো দোকানে নিয়ে গেলে টাচ প্যানেল কিংবা ডিসপ্লে সাইজ অনুযায়ী দোকানদাররা স্ক্রিনটি বদলে দেন। কিন্তু সার্ভিস সেন্টারে গেলে সম্পূর্ণ অন্য ঘটনা ঘটে, সেখানে ইউজারদেরকে পুরো ফোল্ডারটাই পাল্টে ফেলতে বাধ্য করা হয়। তবে রাইট টু রিপেয়ার পলিসির আগমন ঘটলে কোম্পানিগুলির এই ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার অবসান হবে।

নতুন নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ডিভাইসে সমস্যা দেখা দিলে কোম্পানিগুলিকে কেবলমাত্র সেই পার্টসগুলিই রিপ্লেস করতে হবে, যেগুলি খারাপ হয়েছে। এই নীতির আওতায় উপভোক্তারা যে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন, সেকথা নিঃসন্দেহে বলাই বাহুল্য। শুধু তাই নয়, রাইট টু রিপেয়ার পলিসির সৌজন্যে নির্মাতা সংস্থাগুলির ওপর ভোক্তাদের নির্ভরতাও শেষ হবে। এর সুবাদে তারা নিজেদের ইচ্ছামতো ডিভাইস মেরামত করার অধিকার পাবেন।