Android ফোনে কার্ড অ্যাক্টিভেট করতেই ব্যাংক থেকে উধাও ৭ লক্ষ টাকা, নয়া জালিয়াতি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে

জালিয়াতের খপ্পড়ে পড়ে Android ফোনে ক্রেডিট কার্ড অ্যাক্টিভেট করায় ৭ লক্ষ টাকা হারালেন মুম্বাইয়ের এক মহিলা

বিগত কয়েক বছরে (বিশেষত করোনা মহামারীর আগমনের পর) ভারত সহ গোটা বিশ্বজুড়ে সাইবার জালিয়াতির ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দিনের পর দিন নিত্যনতুন ফন্দিফিকির অবলম্বন করে সহজ-সরল সাধারণ মানুষকে ক্রমাগত প্রতারিত করে চলেছে হ্যাকাররা। ক্রমশই সাইবার অপরাধীদের বাড়বাড়ন্ত এতটাই লাগামছাড়া হয়ে উঠছে যে, তাদেরকে কোনোমতেই রোখা সম্ভব হচ্ছে না। একদিকে যেখানে সাইবার সেল এবং পুলিশ অনবরত নানাবিধ স্ক্যাম সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, সেখানে অন্যদিকে মানুষকে প্রতারিত করার জন্য প্রতিনিয়ত হরেক রকমের নতুন উপায় অবলম্বন করছে অনলাইন স্ক্যামাররা। প্রায়শই খবরের শিরোনামে একাধিক সাইবার জালিয়াতির ঘটনা চোখে পড়ে। সেক্ষেত্রে সম্প্রতি আবারও একবার মুম্বাইয়ের এক মহিলা নিজের অজান্তেই স্ক্যামারদের প্রতারণার শিকার হলেন। জানা গিয়েছে যে, তিনি iPhone থেকে একটি নতুন Android ফোনে স্যুইচ করার পর, ক্রেডিট কার্ড অ্যাক্টিভেট করে ৭ লক্ষ টাকা হারিয়েছেন। কিন্তু ঠিক কীভাবে ঘটলো এই শোচনীয় দুর্ঘটনা? আসুন একটু বিশদে জেনে নেওয়া যাক।

জালিয়াতের খপ্পড়ে পড়ে Android ফোনে ক্রেডিট কার্ড অ্যাক্টিভেট করায় ৭ লক্ষ টাকা হারালেন মুম্বাইয়ের এক মহিলা

সম্প্রতি টাইমস নাউ (Times Now)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হালফিলে মুম্বাইয়ের পানভেলের এক মহিলাকে ক্রেডিট কার্ড এবং বিনামূল্যে অ্যান্ড্রয়েড ফোন দেওয়ার নাম করে তাকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলেছে এক দুর্বৃত্ত। রিপোর্ট অনুযায়ী, সৌরভ শর্মা (Saurabh Sharma) নামের এক ব্যক্তি নিজেকে ব্যাংক কর্মী বলে পরিচয় দিয়ে ওই মহিলাকে হঠাৎ একদিন ফোন করে নতুন ক্রেডিট কার্ড এবং শহরের একটি প্রখ্যাত স্পোর্টস ক্লাবের সদস্যপদ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। ফলে আচমকা এরকম একটি আকর্ষণীয় অফার পেয়ে গিয়ে মহিলাটি তৎক্ষণাৎ ওই ব্যক্তির প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। এমনকি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই জ্যাকপটটি হাতে পাওয়ার জন্য তিনি অবিলম্বে ওই প্রতারকের সাথে তার আধার কার্ড সহ যাবতীয় ব্যক্তিগত ডিটেইলসও শেয়ার করে ফেলেন।

এরপর স্ক্যামার শর্মা ওই মহিলাকে জানান যে, ক্রেডিট কার্ডটি শুধুমাত্র অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন ব্যবহার করেই অ্যাক্টিভেট করা যাবে। কিন্তু দেখা যায় যে, ওই মহিলাটি আইফোন ব্যবহার করেন। তবে এই সমস্যাও এক চুটকিতেই সমাধান করে দেন উক্ত জালিয়াত; তিনি তৎক্ষণাৎ মহিলাটিকে জানান যে, নতুন ক্রেডিট কার্ড অ্যাক্টিভেট করার জন্য তিনি তাকে একটি নতুন অ্যান্ড্রয়েড ফোনও দেবেন। স্বভাবতই আরও একটি দুর্দান্ত অফার আকস্মিকভাবে হাতের মুঠোয় পেয়ে যাওয়ায় আনন্দে আপ্লুত হয়ে যান ওই মহিলা, এবং তৎক্ষণাৎ ওই স্ক্যামারকে নিজের বাড়ির ঠিকানাটি দিয়ে দেন, যাতে তিনি ঘরে বসেই নতুন অ্যান্ড্রয়েড ফোনটি পেতে পারেন।

এরপর সমস্ত ডিটেইলস শেয়ার করার পর সেদিনই ওই মহিলা নতুন অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনটি হাতে পেয়ে যান। জানা গিয়েছে যে, ফোনটিতে দুটি অ্যাপ প্রি-ইনস্টল করা ছিল – ডট সিকিউর (DOT Secure) এবং সিকিউর এনভয় অথেনটিকেটার (Secure Envoy Authenticator)। ফোনটি হাতে পাওয়ার পরে, শর্মা ওই মহিলাকে তার সিম কার্ডটি নতুন ফোনে ইনসার্ট করতে বলেন এবং ক্রেডিট কার্ডের অ্যাক্টিভেশন প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করার জন্য তার বলা যাবতীয় নির্দেশাবলী অনুসরণ করার নির্দেশ দেন। এরপর শর্মা যা যা বলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ওই মহিলা ক্রেডিট কার্ড অ্যাক্টিভেশন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন। আর এরপরেই ঘটে যায় এক শোচনীয় দুর্ঘটনা!

ক্রেডিট কার্ড অ্যাক্টিভেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই ওই মহিলার কাছে ব্যাংক ট্রানজ্যাকশন সম্পর্কিত দুটি মেসেজ আসে, যার মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন যে, ওই ক্রেডিট কার্ড মারফত কেনাকাটা করার জন্য তার অ্যাকাউন্ট থেকে ৭ লক্ষ টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। মেসেজ থেকে এও জানা যায় যে, ব্যাঙ্গালোরের একটি গয়নার দোকান থেকে এই লেনদেন হয়েছে। স্পষ্টতই, এই অননুমোদিত লেনদেন সম্পর্কিত মেসেজ পাওয়ার পর মহিলাটি হাড়ে হাড়ে টের পান যে, তিনি নিশ্চিতভাবে সাইবার জালিয়াতির শিকার হয়েছেন। তবে ওইদিন ব্যাংক বন্ধ থাকায় তিনি ট্রানজ্যাকশনের বিষয়টি ভেরিফাই করতে পারেননি। তাই পরের দিন তিনি ব্যাংকের দ্বারস্থ হন এবং তারপরে খন্ডেশ্বর থানায় গিয়ে গোটা ঘটনাটির সম্পর্কে পুলিশকে বিশদে জানিয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। উল্লেখ্য যে, পুলিশ এখন ওই জালিয়াতকে হাতেনাতে ধরার জন্য জোরকদমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ঠিক কী কৌশলে ওই স্ক্যামার মহিলাটিকে প্রতারিত করেছিল?

যদিও উক্ত মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন, তবে এই সাম্প্রতিক জালিয়াতিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে। সেটি হল – নতুন ইস্যু করা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কীভাবে ওই স্ক্যামার মহিলাটিকে প্রতারিত করতে সক্ষম হল? এটা কি কোনো ফিশিংয়ের ঘটনা, নাকি ভুয়ো ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি? সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন যে, আলোচ্য অনলাইন কেসটি সম্ভবত ফিশিংয়ের ঘটনা। উক্ত ঘটনায় স্ক্যামার মহিলাটিকে প্রতারিত করার জন্য একাধিক কৌশলকে হাতিয়ার করেছে এবং সেগুলিকে অত্যন্ত সুচতুরভাবে ধাপে ধাপে অবলম্বন করেছে।

প্রথমত, প্রতারক মহিলাটিকে কল করে একটি ক্রেডিট কার্ড সহ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে একটি বিখ্যাত ক্লাবের বিনামূল্যে সদস্যপদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে প্রলুব্ধ করে তোলে। এই ছুতোয় সে মহিলাটির কাছ থেকে তার আধার, ব্যাংক ডিটেলস সহ যাবতীয় তথ্য হাতিয়ে নেয়। এরপর মহিলাটির কাছে আইফোন আছে দেখে প্রতারক তাকে জানায় যে, ক্রেডিট কার্ডটি অ্যাক্টিভেট করতে হলে একটি নতুন অ্যান্ড্রয়েড ফোনের প্রয়োজন, এবং সেটিও তাকে সম্পূর্ণ ফ্রিতে দিয়ে দেয়।

কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষণীয় ব্যাপার হল, হ্যাকার কর্তৃক প্রদত্ত অ্যান্ড্রয়েড ফোনটিতে দুটি অ্যাপ প্রি-ইন্সটল করা ছিল। সেক্ষেত্রে মনে করা হচ্ছে যে, এই অ্যাপ দুটিই ছিল ম্যালিশিয়াস, যার জেরে ফোনটির মারফত ক্রেডিট কার্ড অ্যাক্টিভেট করা মাত্রই ওই মহিলার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ডের সম্পূর্ণ ডিটেইলস চলে যায় জালিয়াতের হাতে। আর এর সুবাদেই মি. শর্মা নামক ওই হ্যাকার সেটির মাধ্যমে লেনদেন করতে সক্ষম হয়, যার জেরেই ওই মহিলার অ্যাকাউন্ট থেকে খোয়া দিয়েছে ৭ লক্ষ টাকা। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ইউপিআই (UPI) বা নেট ব্যাংকিংয়ে কোনো ফিজিক্যাল কার্ড ব্যবহার না করেই অতি অনায়াসে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা যেতে পারে, আর এক্ষেত্রে প্রতারকও এই একই কাজ করেছে।

সর্বদা সতর্ক থাকুন, সুরক্ষিত থাকুন

তাহলে এখন প্রশ্ন হল, এই ধরনের অসৎ কার্যকলাপকারী মানুষদেরকে কীভাবে রোখা সম্ভব? সেক্ষেত্রে বলি, চলতি সময়ে হ্যাকারদেরকে আটকানোর যেহেতু কোনো উপায় নেই, তাই নিজেদেরকেই যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে হবে। কখনোই অচেনা কাউকে বিশ্বাস করবেন না, এবং কোন লোভনীয় অফার বা পুরস্কারের ফাঁদে আচমকা পা দিয়ে ফেলবেন না। এছাড়া, আধার, ব্যাংক ডিটেইলসের মতো জরুরী তথ্য কখনোই কারোর সাথে ভুলেও শেয়ার করবেন না।

আবার, অচেনা কেউ যদি আপনার কাছ থেকে কোনো পরিষেবার সাথে সম্পর্কিত ওটিপি (OTP) জানতে চায়, তাহলে কোনোমতেই তাকে সেটি দেবেন না। এছাড়া, অজানা নম্বর থেকে আসা ভুয়ো কল এবং এসএমএসের থেকেও ইউজারদেরকে সর্বদা দশ হাত দূরে থাকতে হবে। সেইসাথে অজানা সোর্স থেকে পাওয়া লিঙ্কে ক্লিক করাও একেবারেই উচিত নয়। সর্বোপরি, যদি কেউ বারংবার ফোন বা মেসেজ করে আপনাদেরকে এই ধরনের কাজগুলি করার জন্য জোর কিংবা বাধ্য করে, তাহলে তৎক্ষণাৎ সেই ব্যক্তি এবং তার ফোন নম্বরটির সম্পর্কে সাইবার সেলে রিপোর্ট করুন। মোদ্দা কথা হল, বর্তমান ডিজিটাল যুগে সাইবার জালিয়াতির হাত থেকে বাঁচতে হলে সর্বদা চোখকান খোলা রাখুন, সতর্ক থাকুন, সুরক্ষিত থাকুন।