চাঁদে বাড়ি বানাতে বিশেষ ধরণের ইট তৈরী করছে ভারতীয় বৈজ্ঞানিকরা

পরিবেশ দূষণ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের শোষণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ ফলে ভবিষ্যতে যাতে অন্য কোনো গ্রহ-উপগ্রহকে বিকল্প হিসাবে বাসযোগ্য করে তোলা যায়, বিজ্ঞানীরা সেই বিষয়ক গবেষনা প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছেন ৷ অন্যান্য গ্রহের তুলনায় নিকটবর্তী হওয়ায় মঙ্গলগ্রহে মানব অভিযানের মাধ্যমে সেখানে আস্তানা গড়ে তোলার পরিকল্পনার খবর আমরা পেয়েছি ৷ অনুরূপভাবে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদেও বসতি স্থাপনের জন্য বিশ্বের তাবড় তাবড় মহাকাশ গবেষণা সংগঠনগুলি গবেষণা চালাচ্ছে ৷

এই গবেষণারই অঙ্গ হিসাবে ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ সায়েন্স ব্যাঙ্গালোর (IISc) এবং ইন্ডিয়ান স্পেস রিচার্স অর্গানাইজেশানের (ISRO) একদল বিজ্ঞানী চাঁদে বাড়ির কাঠামো তৈরির জন্য একধরনের ‘স্পেস ব্রীক’ বা “মহাকাশের ইট’ উদ্ভাবন করেছেন। লুনার সয়েল সিমুলেট (LSS) ব্যবহার করে টেকসই পদ্ধতিতে বানানো এই স্পেস ব্রীকের মাধ্যমে চাঁদে ইটের মতো গঠন সম্পন্ন কাঠামো তৈরি করা যাবে বলে জানা গিয়েছে ৷

ইসরোর পেটেন্ট নেওয়া এই লুনার সয়েল সিমুলেট (LSS) কে বলা যেতে পারে চাঁদের মাটির একটি অনুকরন ৷ উল্লেখযোগ্যভাবে, অ্যাপেলো মিশনের মাধ্যমে চাঁদের মাটির যে নমুনা আনা হয়েছিল ৷ রাসায়নিক বৈশিষ্টের দিক থেকে এই লুনার সয়েল সিমুলেটের (LSS) সাথে তার প্রায় ৯৯.৬ শতাংশ সাদৃশ্য পাওয়া গেছে ৷

IISc ব্যাঙ্গালোরের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রোফেসার Dr. Aloke Kumar এর নেতৃত্বে রিচার্সাররা এই স্পেস ব্রীক বানাতে Biomineralization (বায়োমিনারালাইজেশান) নামক একটি প্রাকৃতিক পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়েছেন। জানিয়ে রাখি বায়োমিনারালাইজেশান হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে প্রাণীদেহের (সাধারনত অণুজীব) ভেতরে বা বাইরে খনিজ পদার্থ উৎপন্ন হয় ৷ যেমন- অ্যালগির দেহে সিলিকেটের উপস্থিতি এই বায়োমিনারালাইজেশানের অসংখ্য উদাহরনের মধ্যে একটি বলা যেতে পারে ৷ এই খনিজ পদার্থগুলিই আবার কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য যেমন- কাঁকড়া বা শামুকের দেহের শেলস বা যেটাকে আমরা এক্সোস্কেলেটন বলি সেটির গঠন এবং স্তন্যপায়ী ও পাখিদের দেহে হাড় গড়নেও ভূমিকা নেয় ৷ এই বায়োমিনারালাইজেশানের প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এক প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া Sporosarcina pasteurii (স্পোরোসারসিনা প্যাস্তুরি) ইউরোলাইটিক সাইকেল নামে এক বিপাক প্রক্রিয়ায় প্রাণীদেহের রেচন পদার্থ থেকে পাওয়া ইউরিয়া এবং ক্যালসিয়াম ধাতুর ব্যবহারের মাধ্যমে এই মেটাবলিক প্যাথওয়ের বাইপ্রোকাক্ট হিসাবে ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের ক্রিস্টাল উৎপাদন করতে পারে ৷ ব্যাকটেরিয়াটির এই উপযোগিতার জন্য এটি স্পেস ব্রিকের গঠনকার্যে LSS এর পাশাপাশি অন্যতম কাঁচামালরূপে ব্যবহার করা হয়েছে ৷

প্রোফেসার কুমার একটি ইন্টারভিউতে জানিয়েছেন, বায়োসিমেন্টেশান পক্রিয়ার মাধ্যমে স্পেস ব্রিকটি বানানোর জন্য তাদের টিম রিসার্চরার উপযুক্ত ল্যাব কন্ডিশানে বায়োরিয়াক্টারের মধ্যে লুনার সয়েল সিমুলেটের (LSS) সঙ্গে স্পোরোসারসিনা প্যাস্তুরি, ক্যালসিয়াম ধাতু এবং মূত্রের মিশ্রণ ব্যবহার করেছিলেন ৷ প্রোফেসার কুমার এটাও জানিয়েছেন, যখন বায়োরিয়াক্ট্যারের মধ্যে এই স্পেস ব্রিক বানানোর অনূকুল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তখন সপ্তাহ দুয়েকের মধেই এটি জমাট বেঁধে ইটের মতো আকৃতি গঠন করতে পারবে ৷

তবে এই ব্রিকটির প্রথম উৎপাদনের পর দেখা যায় গঠন নরম হওয়া জন্য সেটি সহজেই ভঙ্গুর ৷ তাই সমাধান হিসাবে রিসার্চাররা গোয়ার মটরশুটি থেকে প্রাপ্ত আঠার মতো নির্যাস ব্যবহার করেন। এবং ফলাফল হিসাবে দেখা যায়, ইটের শক্তি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে প্রশ্নটা থেকেই যায়, এই স্পেস ব্রিক চাঁদের মতো পরিবেশে কতটা টিকে থাকতে পারবে ?

ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ সায়েন্স ব্যাঙ্গালোরের (IISc) আর একজন বিজ্ঞানী রেশমী দিক্ষিত বিকল্প উপায়ে আরো কম খরচে এই স্পেক ব্রিক উৎপাদনের পদ্ধতি সর্ম্পকে জানিয়েছেন ৷ এই পদ্ধতিতে স্পোরোসারসিনা প্যাস্তুরির পরিবর্তে ব্যবহার করা হবে ব্যাসিলাস ভেলেজেনসিস নামে আর একটি প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া ৷ একশিশি স্পোরোসারসিনা প্যাস্তুরির জন্য ৫০, ০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয় ৷ অন্যদিকে ব্যাসিলাস ভেলেজেনসিস দাম সেই খরচের দশ ভাগের এক ভাগ পড়বে ৷

প্রোফেসার কুমার জানিয়েছেন, নতুন উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি পৃথিবীর বাইরে কতটা কর্মক্ষম হবে সেটা জানার জন্য লো-গ্রাভিটি কন্ডিশানে পরীক্ষা করাও জরুরী ৷ চাঁদেও যেহতু পৃথিবীতে মতো ভূমিকম্প হয় ৷ সেক্ষেত্রে এই স্পেস ব্রিকের কাঠামো সেই কম্পন কতটা সহ্য করে টিকে থাকতে সেই নিয়েও তারা গবেষনা শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন ৷