Ambassador 2.0: অ্যাম্বাসেডরের অতীত এবং ভবিষ্যৎ, কিংবদন্তির পুনর্জন্ম কি সফল হবে

স্বাধীনতা লাভের এক দশক সম্পূর্ণ হওয়ার আগে হুগলির উত্তরপাড়ায় অ্যাম্বাসেডর (Ambassador)-এর উৎপাদন শুরু করেছিল হিন্দুস্তান মোটরস (Hindustan Motors) বা এইচএম। ব্রিটিশ সংস্থা মরিসের অক্সফোর্ড সিরিজ ত্রি মডেলের আদলে তৈরি হয়েছিল গোল মাথার গড়নের গাড়িটি। তখন সি কে বিড়লা গোষ্ঠীর শাখা এইচএম কল্পনাও করতে পারেনি যে, ভারতে মোটরগাড়ির ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে অ্যাম্বাসেডরের নাম। হয়ে উঠবে এক কিংবদন্তি ব্র্যান্ড।

আত্মপ্রকাশের পর প্রতিযোগিতাহীন বাজারে টানা চার দশক জুড়ে দেশের রাস্তায় দাপিয়ে বেড়েছে অ্যাম্বাসেডর। আটের দশক পর্যন্ত বলা যেতে পারে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব। নেতা-মন্ত্রী থেকে আমলা, এমনকি সেলিব্রিটিদেরও মন কেড়েছিল গোলগাল চেহারার এই গাড়ি। রাস্তায় অ্যাম্বাসেডর দেখলেই ধরে নেওয়া হত ভেতরে আছেন কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আর লালবাতি লাগানো থাকলে জাগত আলাদা সম্ভ্রম। তখন অ্যাম্বাসেডরকে সমীহ করে করে বলা হত রাজার গাড়ি। কিন্তু সময়ের সাথে নিজেকে বদলাতে না পেরে মুকুট গিয়েছে রাজার। এখন রাজপাটও লুপ্ত।

প্রথমে মারুতি ও জাপানের সুজুকি কর্পোরেশনের গাঁটছড়ায় বাজারে আসা ৮০০ সিসির ছোট গাড়ির চ্যালেঞ্জ। তারপর নয়ের দশকে দেশের অর্থব্যবস্থায় আমূল সংস্কারসাধন তথা উদার অর্থনিতীর আগল খুলে দেওয়ার পর একের পর এক দেশি-বিদেশী গাড়ির আগমনে তীব্র প্রতিযোগিতার উদ্ভবে যুঝতে অক্ষম হয় অ্যাম্বাসেডর। সময়ের সঙ্গে বদলানো পছন্দ ও আধুনিকতার দাপটে তার বিক্রি কমতে থাকে।

হিন্দুস্তান মোটরস আশির দশকে বছরে ২৪ হাজার অ্যাম্বাসেডর বেচত। ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে তা আড়াই হাজারে গিয়ে ঠেকে। ২০১৪ সালে উত্তরপাড়ার কারখানায় তালা পড়ে। যাত্রা শুরুর ৫৭ বছর পর বন্ধ হয় অ্যাম্বাসেডরের উৎপাদন। এখনও কলকাতার হলুদ-কালো ট্যাক্সি এবং বিশেষ করে বাঙালিদের নস্টালজিয়া বাঁচিয়ে রেখেছে প্রিয় অ্যাম্বিকে। তবে স্মৃতিরোমন্থন আর কতদিন?

অ্যাম্বাসেডর ব্র্যান্ড ও তার ব্যবসায়িক স্বত্ব ৮০ কোটি টাকার বিনিময়ে ফ্রান্সের পিউজো কিনে নিয়েছিল কয়েক বছর আগে। আশা করা হয়েছিল, পিউজোর মতো নামী ফরাসি ব্র্যান্ডের হাত ধরে ফের নতুন অবতারে গড়াবে অ্যাম্বাসেডরের চাকা‌। গমগম করবে উত্তরপাড়ার কারখানা। এই নিয়ে চর্চা স্তিমিত হয়ে গেলেও খুব সম্প্রতি সেই জল্পনা উস্কে দিয়েছে হিন্দুস্তান মোটরসের ডিরেক্টর উত্তম সাহার বক্তব্য।

Ambassador 2.0

ঔতিহ্যবাহী অ্যাম্বাসেডর বাজারে ফিরছে নবরূপে। আধুনিক প্রযুক্তি ও হাল ফ্যাশনের নকশাকে সঙ্গী করে প্রত্যাবর্তন করছে এক সময়ের ‘কিং অফ ইন্ডিয়ান রোডস’। তবে শুধু নতুন প্রজন্মের অ্যাম্বাসেডর নয়, ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে প্রথমে দু’চাকার বৈদ্যুতিক গাড়ি ও তারপর চার চাকার ইলেকট্রিক গাড়িও তাদের লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন উত্তম বসু‌। এর জন্য একটি বড় ইউরোপীয় সংস্থার সঙ্গে মৌ বা সমঝোতাপত্র সাক্ষর করেছেন তারা‌। যদিও গোপনীয়তার খাতিরে প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রকাশ করা হয়নি।

তিন দশকের বেশি সময় ধরে বেস্ট সেলিং সেডানের তকমাপ্রাপ্ত অ্যাম্বির প্রত্যাবর্তন ধামাকাদার করতে ইতিমধ্যেই নেমে পড়েছে হিন্দুস্তান মোটরসের সাবসিডিয়ারি (সহযোগী সংস্থা) হিন্দ মোটর ফিনান্সিয়্যাল কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (এইচএমএফসিআই) ও ফ্রান্সের পিউজো। দেশে তৈরি প্রথম গাড়ির নয়া অবতার চালু করার লক্ষ্যে নকশা ও ইঞ্জিন তৈরির কাজ চলছে জোরকদমে।

সূত্রের খবর, নকশায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের চেয়ে মেকওভারকে বেশি প্রাধান্য পেতে পারে। সাবেকি নকশা বজায় থাকলেও দেওয়া হবে আধুনিকতার ছোঁয়া। বর্তমানে ক্রেতারা একটি গাড়িতে যে সব স্ট্যান্ডার্ড ফিচারের প্রত্যাশা রাখেন, তার সবকিছুই উপস্থিত থাকবে নতুন অ্যাম্বাসেডরে। তবে বাঙালিদের জন্য মন খারাপ করে দেওয়া খবর হল, এবার উত্তরপাড়ার বিখ্যাত কারখানায় নয়৷ অ্যাম্বাসেডরের পুনরুজ্জীবনের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে এইচএমএফসিআই-এর চেন্নাইয়ের কারখানাকে। সেখান থেকে তৈরি হয়ে বেরোবে আধুনিক অ্যাম্বাসেডর। অপেক্ষা হয়তো আর বছর দুয়েকের।

দেশের গাড়ি বাজারে প্রতিযোগীর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। গ্রাহকদের মন বুঝতে না পারলে বাজার থেকে নিতে হচ্ছে বিদায়। যার লেটেস্ট উদাহরণ ডাটসন ও ফোর্ড। তবে পুরনো জিনিসের প্রতি মানুষের যে সহজাত আকর্ষণ, সেটাকে আঁকড়ে ধরে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মোটরসাইকেলের বাজারে দুরন্ত কামব্যাক করেছে রয়্যাল এনফিল্ড। রমরমিয়ে বিক্রি হচ্ছে তাদের বিভিন্ন মডেল। রেট্রো ডিজাইন থাকলেও যুক্ত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি‌।

রয়্যাল এনফিল্ডের সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করার ক্ষমতা হিন্দুস্তান মোটরসের রয়েছে বলেই মনে করছে শিল্পমহল। কারণ, সে যুগে দেশের বেহাল রাস্তাতেও আরামদায়ক ও নিরাপদ সফর দিয়ে নিজের বিশেষত্ব জাহির করেছে গাড়িটি। আর দেশে ক্লাসিক গাড়ির অনুরাগীর সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। অ্যাম্বাসেডরের সোফার মতো নরম আসনে আয়েস করে বসে সওয়ারি করতে কে না চাইবে!

অন্য দিকে, হিন্দুস্তান মোটরস তাদের ইতিহাসে এই প্রথম ব্যাটারিচালিত দুই ও চার চাকা গাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করছে। সংস্থার ডিরেক্টরের কথায় “গোটা বিশ্বে ইলেকট্রিক গাড়িই হল ফিউচার”। নাম উল্লেখ না করলেও এক নামী বিদেশি সংস্থার সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার (৫১:৪৯) বা যৌথ সংস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে বার্তা দিয়েছেন তিনি। তার মধ্যে ৫১ শতাংশ অংশিদারিত্ব থাকবে হিন্দুস্তানের হাতে। ২০২৩-এর প্রথম ত্রৈমাসিকে হতে পারে আনুষ্ঠানিক চুক্তি।

হিন্দুস্তান মোটরস জানিয়েছে, পরিকল্পনা সফল হলে উত্তরপাড়ার কারখানা ফের খোলা হবে। প্রথমে সেখানে ইলেকট্রিক স্কুটার-বাইক উৎপাদন হবে। তারপরে চার চাকা। অ্যাম্বাসেডরের বৈদ্যুতিক ভার্সন নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে বলেও জল্পনা শোনা যাচ্ছে। অন্যান্য সংস্থার কাছে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বিক্রি করার পর বর্তমানে ২৭৫ একর জমি পড়ে রয়েছে বিড়লা গোষ্ঠীর হাতে। তার মধ্যে ১০০ একরে নতুন কারখানা নির্মাণ হতে পারে। ফলে একদা ব্যস্ত জনপদকে ঘিরে ফের স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেছে কারখানার পুরনো শ্রমিকদের একাংশ।