ফোনে স্বদেশী জিপিএস পরিষেবা রাখতে Xiaomi, Apple, Samsung-দের সঙ্গে কথা মোদি সরকারের

ভারতকে আত্মনির্ভর করে তোলার লক্ষ্যে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একের পর এক নতুন প্রকল্পের সূচনা করছেন, যার সুবাদে অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে বহু ক্ষেত্রেই এখন ভারত সম্পূর্ণভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সম্প্রতি পাওয়া খবর অনুযায়ী জানা গিয়েছে যে, এবার গোটা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ইউএস গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা GPS (জিপিএস)-এর ওপর নির্ভরতা কাটাতে নিজস্ব নেভিগেশন সিস্টেম ব্যবহার করে বিশ্বের দরবারে ভারতকে সফলতার শীর্ষে পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হয়েছে মোদী সরকার। এর জন্য ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক এবং মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ISRO (ইসরো) হাতে হাত মিলিয়ে স্মার্টফোনে নিয়ে আসতে চলেছে সম্পূর্ণ দেশীয় জিপিএস সিস্টেম, যার নাম দেওয়া হয়েছে NavIC (Navigation with Indian Constellation)। ফলে ভবিষ্যতে স্মার্টফোন প্রযুক্তিতে ভারত যে এক নয়া বিপ্লবের সঞ্চার করতে চলেছে, সেকথা নিঃসন্দেহে বলাই বাহুল্য। শুধু তাই নয়, আগামী দিনগুলিতে স্মার্টফোনে GPS-এর পাশাপাশি যাতে NavIC অপশনটিকেও উপলব্ধ করা হয়, তার জন্য ইতিমধ্যেই হ্যান্ডসেট প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিকে চাপ দিতে শুরু করেছে ভারত সরকার।

মার্কিন মুলুকের ওপর নির্ভরশীলতা কাটাতে স্মার্টফোনে খুব শীঘ্রই আসছে ISRO-র প্রযুক্তি NavIC

রয়টার্স (Reuters)-এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দেশে বিক্রি হওয়া স্মার্টফোনগুলিকে স্বদেশী নেভিগেশন সিস্টেমের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলার জন্য স্যামসাং (Samsung), শাওমি (Xiaomi) এবং অ্যাপল (Apple)-এর মতো টেক জায়েন্টগুলিকে বেশ ভালোরকম চাপ দিতে শুরু করেছে ভারত সরকার। দেশে স্বদেশী নেভিগেশন সিস্টেমভিত্তিক ফোন রোলআউট হলে ভারত আত্মনির্ভর হওয়ার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও বেশ খানিকটা চাঙ্গা হবে বলে আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জিপিএস-কে জোর টক্কর দেওয়ার জন্য চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান এবং রাশিয়া ইতিমধ্যেই তাদের নিজস্ব নেভিগেশন সিস্টেম তৈরি করে ফেলেছে। তবে ২০১৮ সালে NavIC টেকনোলজির আগমন ঘটলেও এতদিন পর্যন্ত এটিকে খুবই স্বল্প পরিমাণে ব্যবহার করা হয়েছে। পাবলিক ভেহিকেল লোকেশন ট্র্যাকারের মতো কিছু ছোটোখাটো জায়গা ছাড়া অন্য কোনো বৃহত্তর ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তিকে বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়নি। তবে এবার মোদী সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে, তাতে এই প্রযুক্তির উপর ভর করে ভারতও উপরিউক্ত দেশগুলির মতো নিজের এক সুযোগ্য তথা মজবুত নেভিগেশন সিস্টেম তৈরি করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যেতে পারে।

খরচ বাড়ার আশঙ্কা করছে টেক কোম্পানিগুলি

মোদি সরকার টেক জায়েন্টগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে যে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে যে স্মার্টফোনগুলি ভারতে বিক্রি হবে, সেগুলিতে যেন জিপিএস-এর পাশাপাশি NavIC টেকনোলজিরও সাপোর্ট থাকে। আর সেজন্য প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে তাদের ডিভাইসে যথাযথ হার্ডওয়্যার পরিবর্তন করার জন্য ইতিমধ্যেই চাপ দিতে শুরু করেছে কেন্দ্র, যার জেরে সরকারের বিরোধিতা করতে শুরু করেছে টেক কোম্পানিগুলি। গত আগস্ট এবং চলতি সেপ্টেম্বরে আয়োজিত হওয়া একাধিক বৈঠকে অ্যাপল, শাওমি, স্যামসাং সহ অন্যান্য একাধিক শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি সংস্থা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, এই স্বল্প কয়েক মাসের মধ্যে সমস্ত স্মার্টফোনগুলিকে NavIC সাপোর্টেড করে তুলতে হলে উৎপাদন খরচ অনেকটাই বেশি পরিমাণে বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি ফোন তৈরির জন্য ব্যবহৃত সরঞ্জাম এবং টেকনোলজিতেও বিস্তর পরিবর্তন আনতে হবে, যা এই কয়েকটা মাসের মধ্যে করা প্রায় দুষ্কর বললেই চলে। ফলে আগামী দিনে মার্কেটে আসতে চলা স্মার্টফোনগুলি লঞ্চের সময়সীমা বেশ খানিকটা পিছিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি যাবতীয় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডও যে বেশ ভালোরকমভাবে ব্যাহত হবে, সেই বিষয়টিরও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে প্রযুক্তি সংস্থাগুলি।

রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারত সরকার কর্তৃক গৃহীত এই সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটিকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে গত ২ সেপ্টেম্বর ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক এবং মহাকাশ সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে শীর্ষস্থানীয় স্মার্টফোন নির্মাণকারী এবং চিপসেট প্রস্তুতকারকদেরকে একজোট করে একটি জোরদার বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। বৈঠকটিতে স্যামসাং-এর ভারতীয় নির্বাহী বিনু জর্জ (Binu George) খরচ বৃদ্ধির বিষয়টির কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি এও জানিয়েছেন যে, NavIC সাপোর্টেড স্মার্টফোন তৈরি করতে হলে শুধুমাত্র অত্যধিক উন্নত মানের চিপসেটই নয়, সেইসাথে আরও অনেক নতুন সরঞ্জামেরও প্রয়োজন হবে। এর ফলে হ্যান্ডসেট নির্মাণের খরচ বহুল মাত্রায় বাড়বে, এবং একইসাথে স্মার্টফোনের হার্ডওয়্যার ডিজাইনেও আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, যা এত কম সময়ের মধ্যে করা কার্যত অসম্ভব বললেই চলে। সেক্ষেত্রে ভারত সরকার কর্তৃক গৃহীত এই উদ্যোগকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে টেক জায়েন্টগুলি কেন্দ্রের কাছ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় চেয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে আরও ভালোভাবে আলোচনা করার জন্য ভবিষ্যতে এরকম আরও অনেক বৈঠকের আয়োজন করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ভারত ছাড়াও এইসব দেশেরও নিজস্ব নেভিগেশন সিস্টেম রয়েছে

আলোচ্য এই NavIC টেকনোলজির প্রসঙ্গে ভারতের মহাকাশ সংস্থা জানিয়েছে, জিপিএস এবং রাশিয়ার গ্লোনাস (GLONASS)-এর মতো সিস্টেমগুলি তাদের দেশের প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলির দ্বারা পরিচালিত হয়, যার ফলে বেসামরিক পরিষেবা ব্যাহত হতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে NavIC সম্পূর্ণরূপে ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যার ফলে ইউজারদেরকে কোনোরকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না। উল্লেখ্য যে, ভারতই প্রথম দেশ নয় যারা স্মার্টফোন সংস্থাগুলিকে নিজস্ব নেভিগেশন সিস্টেম সাপোর্টেড হ্যান্ডসেট তৈরি করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছে; এই তালিকায় ইতিমধ্যেই চীন, রাশিয়া সহ একাধিক দেশের নাম শামিল রয়েছে। সম্প্রতি অ্যাপল কর্তৃপক্ষের তরফে জানা গিয়েছে যে, জিপিএস, রাশিয়ার গ্লোনাস এবং চীনের বাইডু (Beidou) সহ পাঁচটি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নেভিগেশন নেটওয়ার্ক বর্তমানে তাদের আইফোন (iPhone)-এ সাপোর্ট করে; সেক্ষেত্রে ভারতের নির্দেশে তারা আরও একটি নাম এই তালিকায় অনায়াসে যুক্ত করতে পারে।

চিপসেটকে কেন্দ্র করে দেখা দিতে পারে বেশ কিছু সমস্যা

তবে এই সবকিছুর মধ্যে NavIC সাপোর্টেড স্মার্টফোন লঞ্চের ক্ষেত্রে চিপসেট সম্পর্কিত বিষয়টিকে নিয়ে বিশেষ উদ্বেগ দেখা গিয়েছে। উল্লেখ্য যে, NavIC সাপোর্টেড চিপসেট কেনার জন্য বেশিরভাগ স্মার্টফোন নির্মাতাদেরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিপ ডিজাইনার Qualcomm Inc (কোয়ালকম ইনকর্পোরেটেড) এবং তাইওয়ানের MediaTek Inc (মিডিয়াটেক ইনকর্পোরেটেড)-এর মতো নামজাদা সংস্থাগুলির ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। সেক্ষেত্রে এই কোম্পানিগুলি নতুন চিপসেট তৈরির জন্য খরচ যতটা বাড়াবে, তার ওপর ভিত্তি করে স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিকেও তাদের হ্যান্ডসেটের দাম বাড়াতে হবে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, গত ২ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে MediaTek স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, আগামী দিনে 5G (৫জি) ফোনের জন্য কোম্পানির সমস্ত চিপসেট NavIC সাপোর্টেড হবে, তবে তার জন্য খরচ খানিকটা বৃদ্ধি পাবে এবং হার্ডওয়্যারেও বেশ কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। তবে Qualcomm এবং MediaTek উভয়ই NavIC এনাবেলড চিপসেট তৈরির জন্য ভারতীয় মহাকাশ সংস্থার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেক্ষেত্রে ভারত সরকার কর্তৃক গৃহীত এই সাম্প্রতিক উদ্যোগ আগামী দিনে সত্যি সত্যিই বাস্তবায়িত হয় কি না, এখন সেটাই দেখার…