মানব শরীরই কাজ করবে পরিচয়পত্র বা পাসওয়ার্ড হিসেবে, চমকের নাম Biometrics!

বায়োমেট্রিক্স (Biometrics) শব্দটির সঙ্গে এখনকার দিনে কমবেশি সকলেই পরিচিত। আজকাল পরিচয় শনাক্তকরণের জন্য বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি সর্বত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি এবার এই প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে…

বায়োমেট্রিক্স (Biometrics) শব্দটির সঙ্গে এখনকার দিনে কমবেশি সকলেই পরিচিত। আজকাল পরিচয় শনাক্তকরণের জন্য বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি সর্বত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি এবার এই প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে দেশে নতুন ফৌজদারি কার্যবিধি (আইডেন্টিফিকেশন) আইন ২০২২ (Criminal Procedure Identification Act 2022) কার্যকরও হয়েছে। এর আওতায় পুলিশ যেকোনো অপরাধের জন্য গ্রেফতার বা সাজাপ্রাপ্তদের বায়োমেট্রিক নিতে পারবে। উল্লেখ্য, পুরোনো আইন অনুযায়ী ছবি ছাড়াও আঙুলের ছাপ, পায়ের ছাপসহ বন্দিদের শারীরিক মাপ নেওয়ার অনুমতি রয়েছে পুলিশের। আর এবার নতুন আইনের দরুন প্রয়োজনে আইরিশ, রেটিনা স্ক্যান, ফিজিক্যাল এবং বায়োলজিক্যাল স্যাম্পেল, স্বাক্ষর এবং হাতের লেখার নমুনা সংগ্রহেরও অনুমতি দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। শুধু তাই নয়, নয়া আইনের অধীনে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NIB) সমস্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকে যাবতীয় বায়োমেট্রিক্স রেকর্ড সংগ্রহ করবে এবং ৭৫ বছরের জন্য সেগুলিকে ডিজিটাল ফর্ম্যাটে স্টোর করবে বলে জানা গিয়েছে।

এত কিছু জানার পর বায়োমেট্রিক্সের গুরুত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনারা বেশ অনেকটাই আন্দাজ করতে পারছেন। চলতি সময়ে যেখানে এই প্রযুক্তিটিকে কেন্দ্র করে একটি নতুন আইনও প্রণয়ন করা হয়ে গিয়েছে, সেখান থেকেই বর্তমান ডিজিটাল যুগে এই টেকনোলজির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আঁচ করা যায়। স্কুল, কলেজ কিংবা অফিসকাছারির পাশাপাশি স্মার্টফোন, অ্যাটেনডেন্স টেকিং মেশিন ইত্যাদিতেও আজকাল এই প্রযুক্তি অনেক বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু আদতে বায়োমেট্রিক্স কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে, আসুন সে সম্পর্কে একটু বিশদে জেনে নেওয়া যাক।

Biometrics কী?

আপনাদের জানিয়ে রাখি, বায়োমেট্রিক্স হচ্ছে এক ধরনের কৌশল বা প্রযুক্তি, যার সাহায্যে কাউকে শনাক্ত করা যায়। এককথায় বললে, কোনো ব্যক্তিকে শনাক্তকরণের প্রযুক্তি হচ্ছে বায়োমেট্রিক্স। এর মাধ্যমে মানুষের শারীরিক কাঠামো, বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ, প্রভৃতি দ্বারা নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা যায়। বায়োমেট্রিক্স সিস্টেমের সাহায্যে কোনো ব্যক্তিকে শনাক্তকরণের জন্য মূলত যেসব বায়োলজিক্যাল ডেটা ব্যবহৃত হয়, সেগুলি হল – মুখমণ্ডল, রেটিনা ও আইরিশ, হাতের আঙ্গুল, হাতের রেখা, স্বাক্ষর, শিরা এবং কণ্ঠস্বর। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে, প্রতিটি ব্যক্তির বায়োমেট্রিক ডিটেইলস আলাদা। অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তির চোখের রেটিনা বা আঙুলের ছাপ অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে মিলবে না। ফলে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, বায়োমেট্রিক ডিটেইলস প্রতিটি মানুষের একটি অনন্য পরিচয় তৈরি করে। আর তার থেকেও বড়ো কথা হল, কেউ এই ডিটেইলস খুব সহজে হ্যাক বা চুরি করতে পারে না।

Biometrics কীভাবে কাজ করে?

বর্তমানে স্কুল, কলেজ বা অফিস ইত্যাদি অনেক জায়গাতেই বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। আজকাল কম্পিউটার, স্মার্টফোন কিংবা অফিসের অ্যাটেনডেন্স টেকিং মেশিন – সমস্ত জায়গাতেই প্রতিটি ব্যক্তির অনন্য বায়োমেট্রিক ডিটেইলসকে একটি পাসওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই বায়োমেট্রিক ডেটা না মেলা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শনাক্ত করা বা তার ব্যবহৃত কোনো ডিভাইসকেই আনলক করা যায় না। অর্থাৎ সহজ কথায় বললে, বায়োমেট্রিক সিকিউরিটি মারফত মানব শরীরই হয়ে ওঠে কোনো ডিভাইসকে আনলক করার চাবি বা পাসওয়ার্ড।

মূলত বায়োমেট্রিক্স স্ক্যানারগুলি হল হার্ডওয়্যার, যা পরিচয়ের প্রমাণীকরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। একবার কারোর বায়োমেট্রিক ডেটা নেওয়া হয়ে গেলে সেটি সংশ্লিষ্ট ডিভাইসে ভবিষ্যতের জন্য স্টোর করা থাকে। যত দিন যাচ্ছে, বায়োমেট্রিক্সের ব্যবহার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে কারণ এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা খুবই সহজ। যেহেতু ফিজিক্যাল ডিটেইলসের সাহায্যে শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়, ফলে এগুলি সবসময় মানুষের সাথেই থাকে। সেক্ষেত্রে পাসওয়ার্ড বা চাবির মতো সঙ্গে রাখতে ভুলে যাওয়া, কিংবা হারিয়ে যাওয়া বা চুরি যাওয়ার মতো ঘটনাগুলি বায়োমেট্রিক ডিটেইলসের সাথে ঘটার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

কীভাবে এবং কোথায় Biometrics ব্যবহার করা হচ্ছে?

আগেই বলেছি বায়োমেট্রিক সিকিউরিটির জন্য সাধারণত ভয়েস রেকগনিশন, ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানিং, ফেসিয়াল রেকগনিশন, আইরিশ রেকগনিশন, হার্ট রেট সেন্সর ব্যবহার করা হয়। ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানিংয়ের ক্ষেত্রে ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার যন্ত্রের মাধ্যমে নেওয়া কোনো ব্যক্তির দুই হাতের যেকোনো আঙুলের ছাপের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা যায়। কম্পিউটার ডেটাবেসে এই ডেটা স্টোর করে রাখা হয়। ফলে পরবর্তীকালে যেকোনো সময় স্ক্যানারে ওই ব্যক্তির আঙুল এসে পড়লেই তৎক্ষণাৎ তাকে নির্ভুলভাবে সনাক্ত করা যায়। মূলত অফিসে অ্যাটেনডেন্সের ক্ষেত্রে এই টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়।

আবার, ভয়েস রেকগনিশনে কোনো ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয় তাঁর গলার স্বরের ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে বায়োমেট্রিক ডিভাইসের সামনে কিছু বলতে হয়। এরপর তার ভয়েস যন্ত্রে রেকর্ড করা থাকে এবং পরবর্তীকালে ওই ডিভাইসের সামনে সংশ্লিষ্ট হয় আবার কিছু বললেই তাকে শনাক্ত করা যায়। অন্যদিকে, আইরিশ স্ক্যানারে মানুষের চোখের রেটিনা স্ক্যান করা হয়। যেখানে, ফেস স্ক্যানারের সাহায্যে কোনো ব্যক্তির মুখ স্ক্যান করে তাকে শনাক্ত করা হয়ে থাকে। সবথেকে বড়ো কথা হল, উপরিউক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে কোনো ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা সম্ভব। তাই আজকাল সমস্ত নামজাদা কোম্পানিতেই এই টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়। ক্যাসপারস্কি (Kaspersky)-র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিটিব্যাংক ইতিমধ্যেই বায়োমেট্রিক্সের জন্য ভয়েস রেকগনিশন ব্যবহার করছে। আবার, ব্রিটিশ ব্যাংক হ্যালিফ্যাক্স আরো দু কদম এগিয়ে! তারা হার্ট রেটের মাধ্যমে কর্মীদের শনাক্ত করে।

Biometric স্ক্যানার কতটা নিরাপদ?

বায়োমেট্রিক্স প্রযুক্তি বর্তমানে অথেন্টিকেশন বা প্রমাণীকরণের জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য সমস্ত প্রযুক্তির চেয়ে নিরাপদ। সাধারণত বায়োমেট্রিক ডেটা হ্যাক করা খুবই কঠিন। পাসওয়ার্ড চুরি করার চাইতে বায়োমেট্রিক ডেটা হ্যাক করতে হলে সাইবার আক্রমণকারীদের রীতিমতো কালঘাম ছুটে যায়। তবে দুর্জনের যেহেতু ছলের অভাব হয় না, তাই বায়োমেট্রিক ডেটা হ্যাক করা চূড়ান্ত পরিমাণে অসম্ভব হলেও তাকে সম্ভব করার একাধিক কৌশল হ্যাকারদের কাছে মজুত রয়েছে। তাই অনেক সময় বায়োমেট্রিক্স টেকনোলজির মতো আঁটোসাটো নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও পরাস্ত করে শেষমেশ জয়ী হয় স্ক্যামাররা। নকল মুখ বানিয়ে কিংবা ভুয়ো আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে জালিয়াতির ঘটনা বিশ্বের বহু জায়গাতেই লক্ষ্য করা গেছে। তবে সব জিনিসেরই ভালো এবং খারাপ দুটি দিকেই রয়েছে; সেক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় কিছু ঘটনাকে বাদ দিলে সার্বিকভাবে জনসাধারণের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক্স প্রযুক্তি যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেকথা বলাই বাহুল্য।