শিশু পর্নোগ্রাফি রুখতে সবার ব্যক্তিগত মেসেজে ঢুঁ মারার প্রস্তাব, গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ইউরোপবাসী

শিশু নির্যাতন এবং পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত কোনো মেসেজ আদান-প্রদান করা নিতান্তই এক জঘন্য অপরাধ, আর এই কাজের জন্য উপযুক্ত শাস্তি দিতে বহু দেশেই কড়া আইন প্রণয়ন…

শিশু নির্যাতন এবং পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত কোনো মেসেজ আদান-প্রদান করা নিতান্তই এক জঘন্য অপরাধ, আর এই কাজের জন্য উপযুক্ত শাস্তি দিতে বহু দেশেই কড়া আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে এবার অবাধে এবং অবলীলায় যাতে ইউজাররা এই ধরনের স্পর্শকাতর বিষয় সম্পর্কিত মেসেজ চালাচালি না করতে পারে, তার জন্য একটি নতুন নিয়ম চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন (European Commission)। এই নিয়মের আওতায়, সমস্ত প্রাইভেট মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনগুলিকে তাদের ব্যবহারকারীদের যাবতীয় চ্যাট স্ক্যান করতে হবে, এবং যে সকল ইউজাররা এই কাজ করছে বলে জানা যাবে, তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু এই ধরনের মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে (যেমন – WhatsApp, iMessage, এবং Snapchat) সমস্ত চ্যাট যেহেতু এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড থাকে, তাই মহৎ কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে এই আইন চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও ইতিমধ্যেই তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

নতুন এই নিয়ম চালু করার পিছনে ইউরোপীয় কমিশনের মূল উদ্দেশ্য হল, যে-কোনো ইন্সট্যান্ট মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম থেকে পর্ন সম্পর্কিত মেসেজ দূরীকরণ করা। তাই তারা চায় যে, সমস্ত মেসেজিং অ্যাপগুলি তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে শিশু নির্যাতন এবং পর্নোগ্রাফির সাথে সম্পর্কিত কনটেন্ট (যা সম্মিলিতভাবে CSAM, অর্থাৎ চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ মেটেরিয়াল নামে পরিচিত) শনাক্ত করে সেই সমস্ত ইউজারদের অ্যাকাউন্টকে ব্লক এবং রিমুভ করুক। ব্যবহারকারীদের পাঠানো সমস্ত টেক্সট, ফটো, এবং ভিডিও স্ক্যান করার জন্য মেসেজিং অ্যাপগুলিকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং মেশিন ভিশন টুলসের সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু সমস্যাটি হল, এই ধরনের কাজ করতে গেলে মেসেজিং প্ল্যাটফর্মগুলিকে ইউজারদের যাবতীয় মেসেজ স্ক্যান করতে হবে, যা ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তার শর্তকে লঙ্ঘিত করবে।

যদিও নতুন নিয়মের আওতায় প্রাইভেট মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনগুলিকে যে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশনের সাথে আপোষ করতেই হবে, এমন কথা কিন্তু ইউরোপীয় কমিশনের তরফে জানানো হয়নি। কিন্তু ইউজারদের গোপনীয়তা তথা সুরক্ষার ক্ষেত্রে নয়া নিয়ম যে বেশ ভালোরকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত বিশেষজ্ঞমহলের একাংশ। তাছাড়া, পর্ন মেসেজ সেন্ড করলে এই আইনের সহায়তায় কীভাবে ইউজারদেরকে টার্গেট করা হবে, সে সম্পর্কেও এখনও নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায়নি। তবে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত মেসেজের ওপর নজরদারি চালানোর জন্য ইউরোপীয় কমিশনের এই নয়া নিয়মকে ইতিমধ্যেই ‘সবচেয়ে ভয়ংকর জিনিস’ (the most terrifying thing) বলে অভিহিত করেছেন ক্রিপ্টোগ্রাফি অধ্যাপক ম্যাথু গ্রিন (Matthew Green)।

আবার, ডিজিটাল অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ইউরোপিয়ান ডিজিটাল রাইটস (EDRi)-এর জ্যান পেনফ্র্যাটের (Jan Penfrat) মতে, ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করে এই ধরনের আইন লাগু করার বিষয়টি নিতান্তই লজ্জাজনক, এবং যে-কোনো মুক্ত গণতন্ত্রের জন্য সম্পূর্ণভাবে অযোগ্য। অন্যদিকে, ইলেক্ট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশনের ডিজিটাল রাইটস গ্রুপের সিনিয়র পলিসি অ্যানালিস্ট জো মুলিন (Joe Mullin) CNBC-কে জানিয়েছেন যে, সত্যিই যদি এই আইন কার্যকর হয়, তবে কেবল ইউরোপেই নয়, বরং সারা বিশ্বের ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা ও সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়টি ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত হবে।

আবার, নাগরিকদের ওপর নজরদারি চালানোর জন্য বিভিন্ন দেশের স্বৈরতন্ত্রী প্রশাসকেরা এই আইনের অপব্যবহার করতে পারে বলেও অনেকেই মনে করছেন। সোজা কথায় বললে, সমাজ তথা দেশের সার্বিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে শিশু নির্যাতন এবং পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত মেসেজের আদান-প্রদান রুখতে ইউরোপীয় কমিশন এই নিয়ম চালু করার প্রস্তাব দিলেও আখেরে তার বিভিন্ন গুরুতর কুপ্রভাবের কথাই সামনে আনছেন প্রাইভেসি অ্যাডভোকেটমহলের হর্তাকর্তারা। এবার এই সব দিক বিচার-বিবেচনা করে সবশেষে ইউরোপীয় কমিশন আগামী দিনে কী সিদ্ধান্ত নেয়, এখন সেটাই দেখার।

WhatsApp Follow Button

লেটেস্ট খবর পড়তে হোয়াটসঅ্যাপে

WhatsApp Logo যুক্ত হোন