ভিডিও গেমের আসক্তি থেকে সন্তানকে কীভাবে বাঁচাবেন, নির্দেশিকা জারি কেন্দ্রের

Avatar

Published on:

পাবজি (PUBG) বা ফ্রি ফায়ার (Free Fire) এর মতো উত্তেজনাপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চার ভিডিও বা মোবাইল গেমের আবির্ভাবের সাথেই অনলাইন গেমিংয়ের প্রতি ব্যাপক ভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে সমাজের যুব তথা কিশোর সম্প্রদায়। বিশেষত, শিশুদের মধ্যে আসক্তির পরিমান বর্তমানে এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, তারা নানা রকম মানসিক অবসাদে ভোগার পাশাপাশি অল্পতেই মেজাজ হারাচ্ছে। এমনকি, অপরাধ মূলক কাজকর্মেও লিপ্ত হতেও পিছপা হচ্ছে না অনেকে। যেমন, চুপিসারে অভিভাবকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ইন-গেম কেনাকাটা করার দরুন লক্ষ্যধিক টাকা ব্যয় করার খবর সম্প্রতি খবরে এসেছে। আর এরূপ ব্যবহারের ফলস্বরূপ, অভিভাবকের থেকে কড়া শাস্তি পাওয়ার আতঙ্ক বা স্বীয় অপরাধবোধ বহু শিশুকে আত্মহত্যার পথেও ঠেলে দিয়েছে। তাই, শিশু মনস্তত্ত্বের উপর অনলাইন গেমের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে অভিভাবক ও শিক্ষকদের সচেতন করতে, ‘Ministry of Education’ ওরফে MOE, “চিলড্রেন’স সেফ অনলাইন গেমিং” (Children’s safe online gaming) বিষয়ে সম্প্রতি কিছু নির্দেশনা জারি করেছে।

“Children’s safe online gaming” বিষয়ে নতুন নির্দেশনা জারি করলো সরকার

MOE তাদের নির্দেশিকায়, শিশুদের মানসিক তথা শারীরিক চাপ কাটিয়ে তুলতে এবং অনলাইন গেমিংয়ের প্রতি তাদের নিরাসক্ত করতে অভিভাবক ও শিক্ষকদের কী কী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, তা জানানো হয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে, অনলাইন গেমগুলিকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যাতে পূর্ববর্তী স্তরের তুলনায় পরবর্তী স্তর আরও জটিল হয়। যার ফলে, গেমাররা ক্রমশ মরিয়া হয়ে ওঠে তাদের পারফরম্যান্স উন্নতি করার জন্য। আর ফলস্বরূপ, তারা গুরুতর ভাবে আসক্ত হয়ে পরে গেমের প্রতি। এই ঘটনা, ‘গেমিং ডিসঅর্ডার’ হিসাবে বিবেচিত হয়, যা একপ্রকারের ‘মেন্টাল হেলথ ডিসঅর্ডার’ রূপে WHO দ্বারা প্রত্যায়িত।

MOE এর রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, লকডাউনের কারণে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায়, ফোন বা ট্যাবলেটের ওপর শিশুদের নির্ভরতা বহুগুন বেড়ে গেছে। শুরুতে শুধুমাত্র অনলাইন ক্লাসে ভাগ নেওয়ার জন্য ডিভাইসগুলি ব্যবহৃত হলেও, পরে অনলাইন গেমের আঁতুরঘর হয়ে ওঠে এগুলি। যার দরুন প্রায় প্রতিটি শিশু এখন সর্বক্ষণ মাথা গুঁজে রাখে ফোন বা ট্যাবের স্ক্রিনে। এমনকি, অভিভাবকদের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেও চলতে থাকে তাদের ‘গেমিং’ সফর। এই লক্ষণ ‘গেমিং ডিসঅর্ডার’ এর। তদুপরি, বিভিন্ন গেমিং স্তর পেরোতে ইন-অ্যাপ কেনাকাটা করতে শিশুদের বাধ্য করা বা প্রলোভন দেখানোর জন্য, সরকার গেমিং সংস্থাগুলিকেও সমান ভাবে দায়ী করেছে৷

সরকারের পক্ষ থেকে, পিতা-মাতার সম্মতি ছাড়া বাচ্চাদের ইন-গেম কেনাকাটার অনুমতি না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে, ওটিপি (OTP) ভিত্তিক অর্থপ্রদানের পদ্ধতি গ্রহণ করা, সাবস্ক্রিপশনের জন্য অ্যাপগুলিতে ক্রেডিট এবং ডেবিট কার্ড নিবন্ধন এড়ানো, লেনদেন পিছু ব্যয়ের একটি উচ্চ সীমা বা লিমিটেশন নির্ধারণ করা, এবং শিশুদের সরাসরি ল্যাপটপ বা মোবাইল থেকে গেমিং প্রোডাক্ট কিনতে না দেওয়ার, নির্দেশিকা দিয়েছে আরবিআই (RBI)। একই সাথে, অনলাইন গেম যে আর্থিক ব্যয় ও সময় অপচয়কে উৎসাহিত করে সেই সম্পর্কে সন্তানদের বোঝানোর, পরামর্শ দেওয়া হয়েছে অভিভাবকদের।

অনলাইন গেম খেলার ক্ষেত্রে শিশুদের কি কি উপেক্ষা করা উচিত?

নির্দেশিকায় সুপারিশ করা হয়েছে, শিশুরা যেন অচেনা ওয়েবসাইট থেকে সফ্টওয়্যার ও গেম ডাউনলোড না করে। অথবা, ওয়েবসাইটে দেওয়া লিঙ্ক, ছবি এবং পপ-আপগুলিতে ক্লিক করার বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কারণ, এমনটা করলে ডিভাইস ভাইরাস আক্রান্ত হতে পারে। আবার, এগুলিতে বয়স-অনুপযুক্ত সামগ্রীও থাকতে পারে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, গেমিং প্রোফাইল তৈরি করার সময় শিশুরা যাতে ইন্টারনেটে ব্যক্তিগত তথ্য না দেয় সেই সম্পর্কে মা-বাবাদের সচেতন থাকতে হবে। এর জন্য নিজের সঠিক নাম ব্যবহার না করে একটি ছদ্ম নাম (অবতার) ব্যবহার করতে পারে শিশুরা। আবার, ওয়েব ক্যাম বা অনলাইন চ্যাটের মাধ্যমে অপরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন না করার কথাও জানানো হয়েছে। কারণ, অসৎ ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এলে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। এক্ষেত্রে শিশুদের বোঝাতে হবে যে, অনলাইন গেম খেলার সময় কিছু ভুল হয়ে গেলে, অবিলম্বে উইন্ডো বন্ধ করে দেওয়া এবং স্ক্রিনশট (কীবোর্ডে ‘প্রিন্ট স্ক্রিন’ বোতাম ব্যবহার করে) নিয়ে অভিভাবকদের জানানো হবে তাদের প্রথম করণীয়। এছাড়া, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে দীর্ঘক্ষণ গেম খেলতে বারণ করা হচ্ছে।

শিশু ও ব্যক্তিগত ডেটা সুরক্ষিত রাখতে অভিভাবকদের কী করণীয়?

MOE এর নির্দেশিকায় অভিভাবকদের জন্য বলা হয়েছে যে, তারা যেন ডিভাইসে অতিঅবশ্যই অ্যান্টিভাইরাস এবং স্পাইওয়্যার প্রোগ্রাম ইনস্টল করেন। একই সঙ্গে ফায়ারওয়াল বা প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ব্যবহার করে নিরাপদে ওয়েবসাইট ব্রাউজার করার কথাও জানানো হয়েছে। এমনটা করলে, সন্তানরা, ডিভাইসে কোন অ্যাপ ডাউনলোড করছে বা সাইট ব্রাউজ করছে তা পিতা-মাতার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এছাড়া, সরকার নির্দেশ দিয়েছে যে, “আপনার সন্তান যে গেম খেলছে, সেগুলির ‘এজ রেটিং’ পরীক্ষা করুন। সেই সঙ্গে নজর রাখুন বাড়ির কম্পিউটার থেকে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করে বাচ্চারা অপরিচিত ব্যক্তিকে কোনও মূল্যবান তথ্য তুলে দিচ্ছে কিনা।” শিশুরা কোনো প্রকারের হুমকি পেলে, তাদের বকাবকি না করে, অবিলম্বে ‘সাইবার বিভাগে’ রিপোর্ট করার কথাও বলা হয়েছে। এমনটা করলে, সেই ব্যক্তিকে গেম থেকে ব্লক, মিউট বা আনফ্রেন্ড করে দেওয়া হবে।

সর্বোপরি, বাচ্চাদের গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্য, তাদের সঙ্গে নিজেরাও খেলতে বসে যেতে পারেন অভিভাবকেরা। তাহলে, আপনার সন্তান কোনও ব্যক্তিগত তথ্য বাইরের কোনো ব্যক্তির হাতে তুলে দিচ্ছে কিনা বা সংবেদনশীল তথ্যের ভুল ব্যবহার করছে কিনা, সেই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবেন। পাশাপাশি আপনার সন্তানকে বুঝতে সাহায্য করুন যে, অনলাইন গেমের মধ্যে যেগুলি অর্থের বিনিময়ে খেলতে দেয়, সেগুলো হল জুয়া স্বরূপ। এক্ষেত্রে, জুয়া খেলার ফলাফল কী হতে পারে, তাও জানান সন্তানকে।

এখন যেহেতু স্কুল খুলে গেছে, সেহেতু অভিভাবকদের সাথে শিক্ষকদেরও সমান ভাবে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার ও পারফরম্যান্সের উপর নজর রাখতে বলা হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। যেমন, নিম্মমুখী গ্রেড বা অস্বাভাবিক সামাজিক আচরণ হল ‘গেমিং ডিসঅর্ডার’ এর অন্যতম লক্ষণ, যা খেয়ালে রাখা দরকার। এক্ষেত্রে, শিক্ষকদের নিশ্চিত করা উচিত যে শিশুরা যেন ইন্টারনেটের সুবিধা এবং অসুবিধা সম্পর্কে অবগত হয়। একই সাথে, “শিক্ষার্থীদের ‘সেফ’ ওয়েব ব্রাউজিং এবং ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোডের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার” পরামর্শও দেওয়া হয়েছে শিক্ষকদের।

সঙ্গে থাকুন ➥