গাড়িতে ফ্লেক্স ফুয়েল ইঞ্জিনে সায় ভারত সরকারের, তিন মাসের মধ্যেই প্রকল্প শুরু, কমবে জ্বালানি খরচ

Avatar

Published on:

বর্তমানে পেট্রল-ডিজেলের অগ্নিমূল্য দামে আমজনতার নাভিশ্বাস উঠেছে। সমস্যা কিছুটা লাঘবের উদ্দেশ্য নিয়ে ভারত সরকার এবার বিকল্প জ্বালানি ইথানল ভিত্তিক ফ্লেক্স ইঞ্জিন (Flex Engine) বা ফ্লেক্সিবেল ইঞ্জিন তৈরিতে অনুমতি দিয়েছে। গতকাল এ কথা জানালেন দেশের সড়ক পরিবহণমন্ত্রী নিতিন গডকড়ী (Nitin Gadkari)৷ এক্ষেত্রে নতুন ফ্লেক্স ফুয়েলের গাড়ি এমনভাবে ডিজাইন করা হবে, যাতে পেট্রোলের সাথে ইথানল মিশিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ফ্লেক্স ইঞ্জিন প্রকল্প ৩ মাসের মধ্যে চালু করে ভারত সরকার এক ঢিলে দু’পাখি মারতে চায়। প্রথমত, স্থানীয় খামারে উৎপন্ন হয় বলে ইথানল জীবাশ্ম জ্বালানি নয়, এটি পরিবেশবান্ধব। দ্বিতীয়ত, দূষণের পাশাপাশি তেল আমদানির খরচ ছেঁটে রাজকোষের চাপ কমানো।

গডকড়ী বলেছেন, সরকার এর মধ্যেই ১০০ শতাংশ ইথানল পেট্রোল পাম্প স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। তিনি যোগ করে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi) ইতিমধ্যে পুনেতে এ জাতীয় দু’টি ইথানল পেট্রোল পাম্পের উদ্বোধন করেছেন। আমরা আখের রসের গুড় থেকে ইথানল তৈরি করতে পারি এবং এখন সরকার ভাত, ভুট্টা, এবং খাদ্যশষ্য থেকে ইথানল তৈরি করার অনুমতি দিচ্ছে।”

ফ্লেক্স ফুয়েল ইঞ্জিন আদতে কী, এর সুবিধা-অসুবিধা, এবং বাধ্যতামূলক হলে অটোমোবাইল সংস্থাগুলি কেমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, এছাড়াও নানা বিষয় নিয়ে নীচে আলোচনা করা হল।

ফ্লেক্স ফুয়েল ইঞ্জিন বা ফ্লেক্স জ্বালানির ইঞ্জিন আদতে কী

ফ্লেক্স ফুয়েল ইঞ্জিন কে অনেকসময় ডুয়েল ফুয়েল ইঞ্জিন হিসেবেও ডাকা হয়। এর কার্যপ্রণালী বোঝাও অত্যন্ত সহজ৷ আমরা সবাই জানি, প্রথাগত গাড়িতে ইন্টারনাল কম্বাশন ইঞ্জিনে দহনকারকের (সাধারণত বাতাস) উপস্থিতিতে জ্বালানির (সাধারণত পেট্রোল/ডিজেলে) দহন সংগঠিত হয়। ফ্লেক্স ফুয়েল গাড়ির ক্ষেত্রে এমন এক ধরণের ইন্টারনাল কম্বাশন বা আইসি ইঞ্জিন লাগানো থাকে বা এমনভাবে সেটি ডিজাইন করা হয়, যাতে একইসময়ে একের বেশি বিকল্প জ্বালানির উপস্থিতিতে (পেট্রোলের সাথে ইথানল বা পেট্রোলের সাথে মিথানল মিশিয়ে) দহন সংগঠিত হয়ে ইঞ্জিনের ঘূর্ণনশীল অংশগুলোতে শক্তি সরবরাহ করতে পারে। অর্থাৎ ফ্লেক্স জ্বালানির গাড়ি পুরোপুরি ইথানল বা পেট্রোল/ইথানলের সংমিশ্রনে চলতে পারে।

উল্লেখ্য, পেট্রোল/ইথানল বা পেট্রোল/মিথানল, এই দু’ধরণের জ্বালানিতে চলা গাড়িতে কিন্তু দু’টো ফুয়েল ট্যাঙ্কের প্রয়োজন হয় না। একটি ট্যাংকেই পেট্রোলের সাথে ইথানল বা মিথানল স্টোর করা থাকে।

ইথানল/মিথানল কী এবং এর সুবিধা

ইথাইল এক ধরণের বায়োফুয়েল যা ইথাইল অ্যালকোহল থেকে তৈরি হয়। আখ, ভুট্টা, আলু প্রভৃতি ফার্মেনটেশন প্রক্রিয়ায ইথানল উৎপন্ন করে। মিথানল আসলে ইথানলের মতো অ্যালকোহলের একটি ভ্যারিয়েন্ট। রাসায়নিক গঠন দেখলে, ইথিনলের প্রত্যেকটি অণুতে দু’টি কার্বন বর্তমান। সেখানে মিথানলের প্রত্যেকটি অণুতে একটি কার্বন রয়েছে।

বর্তমানে পেট্রোলের দাম একাধিক রাজ্যে  প্রতি লিটার ১০০ টাকা পার করেছে। সেখানে লিটার পিছু ইথানল কিনতে খরচ ৬০-৬২ টাকা। সুতরাং, ইথানল ব্যবহার করে গাড়ি চালানো হলে জ্বালানির খরচ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমবে। পেট্রোলের থেকেও এটি ভাল মানের জ্বালানি, স্বল্প ব্যয় সাপেক্ষ, দূষণমুক্ত। আবার যেহেতু এটি পুননর্বীকরণযোগ্য সংস্থান থেকে তৈরি, তাই একে পরিবেশ বান্ধব হিসেবে গণ্য করা যায়।

পাশাপাশি দেশের কৃষক ও দেশের অর্থনীতিতে ফুয়েল হিসেবে ইথানল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। ভারতে চাল, গম, ভুট্টা, চিনি বাড়তি হিসেবে থাকে। এই উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করে রাখার জন্য সবজায়গায় তেমন উন্নত পরিকাঠামো নেই। ফলে এগুলি ইথানল তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ফ্লেক্স ফুয়েল ইঞ্জিন কোনও নতুন প্রযুক্তি নয়

ফ্লেক্স ফুয়েল ইঞ্জিন কোনও নতুন বিষয় নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘদিন ধরেই এই ধরণের গাড়ির উৎপাদন হচ্ছে। বিশ্বের মোট চারটি দেশে ফ্লেক্স ফুয়েল ইঞ্জিনযুক্ত গাড়ির সবচেয়ে বেশি চল রয়েছে – ব্রাজিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, এবং সুইডেন। ব্রাজিলের ৫০ শতাংশের বেশি গাড়ি ফ্লেক্স ফুয়েলে চলে। এই দেশুগুলিতে, গাড়ি ব্যবহারকারীরা ১০০ শতাংশ গ্যাসোলিন (পেট্রল) বা ১০০ শতাংশ বায়ো-ইথানল ব্যবহার করতে পারেন।

পেট্রোলের সাথে কতটা পরিমাণে ইথানল মেশানো যাবে

সরকারী নিয়মে বর্তমানে প্রতি লিটার পেট্রোলে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ইথানল মেশানোর অনুমতি পাওয়া যায়। যদিও ২০২৪ সালের মধ্যে সেটা বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হতে পারে। ভারতের ১৫টি রাজ্যে ১০ শতাংশ ব্লেন্ডেড পেট্রোল দেখা যায়। বাকি রাজ্যে পেট্রোলের সাথে ইথানল ব্লেন্ডিংয়ের পরিমাণ ০-৫ শতাংশ। ফ্লেক্স ফুয়েল গাড়ি এমনভাবেই বানানো হবে যাতে বিভিন্ন ধরনের আনব্লেন্ডেড বা ব্লেন্ডেড ফুয়েল ব্যবহার করা যায়।

ফ্লেক্স ফুয়েল ইঞ্জিন বাধ্যতামুলক হওয়ায় গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থাগুলি সমস্যার মুখে পড়তে পারে

বিগত কয়েকমাস ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজ্য সরকার ইলেকট্রিক বা বৈদ্যুতিক গাড়ির বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বাড়ানোয় জোর দিচ্ছে। লক্ষ্য, দূষণের পাশাপাশি তেল আমদানির খরচ ছেঁটে রাজকোষের চাপ কমানো। এই পরিস্থিতিতে দেশের অটোমোবাইল সংস্থাগুলি বৈদ্যুতিক গাড়ির বিকাশে মনোনিবেশ করেছে। ফলে ফ্লেক্স ফুয়েল ইঞ্জিন বাধ্যতামুলক হলে টেকনোলজি ট্রান্সফারের পাশাপাশি একটা বড় অঙ্কের বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। সুতরাং, গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি সমস্যার মুখে পড়তে পারে।

ফ্লেক্স ফুয়েল গাড়ির প্রধান অসুবিধা

প্রথাগত গাড়ির চেয়ে ফ্লেক্স ফুয়েল গাড়ি কিছুটা কম মাইলেজ দেয়। আর ভারতের মতো দেশে কম মাইলেজের গাড়ি কতটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে ইঞ্জিন কেমনভাবে ডিজাইন করা হবে তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

আরেকটি সমস্যাটি হল ইথানলের রসায়ন। হায়গ্রোস্কোপিক হওয়ার ফলে ইথানল বায়ু থেকে আর্দ্রতা শোষণ করে। ফলে ফ্লেক্স ফুয়েল বেশি পরিমাণে আর্দ্রতা শোষণ করলে গাড়ির ইঞ্জিন কিন্তু জ্যাম হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

হোয়াটসঅ্যাপে খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন

সঙ্গে থাকুন ➥